মধ্যযুগে বাংলায় সুফিবাদের উদ্ভব ও বিকাশ, সুফিবাদের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ।

মধ্যযুগে বাংলায় সুফিবাদের উদ্ভব ও বিকাশ

বাংলায় হিন্দু শাসনের পতন এবং মুসলিম শাসনের সূচনা ঘটেছিল ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বখতিয়ার খলজি নামক একজন আফগান সেনাপতির হাত ধরে। সে বাংলা এবং বিহার জয় করেছিল তৎকালীন হিন্দু রাজাদের কাপুরুষতা এবং পারস্পরিক বিভেদকে কাজে লাগিয়ে, সাল ১২০৪

তার অভিযানর লক্ষ্য যে শুধুমাত্র রাজ্য বিজয় ছিলনা সে বিষয়ে ইতিহাস বিশারদ পণ্ডিতগণ একমত। ইতিহাস থেকে জানা যায়, পূর্ব ভারতে তার অভিযানের সময়ই আলিমদের ইসলামী দাওয়াতের কাজ সর্বাধিক সাফল্য অর্জন হয়েছিলো এবং ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে বাংলায় সবচেয়ে বেশি মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। খলজির পূর্বপুরুষেরা ছিল তুর্কীস্তানের অধিবাসী। তথাকথিত জিহাদি এই যোদ্ধা ১১৯৩ সালে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় পুরোপুরি ধ্বংস করে।

তৎকালীন বাংলার রাজা লক্ষণ সেনকে অতর্কিত আক্রমনের মাধ্যমে বাংলা জয় করে। অথচ দুঃখের বিষয় এই যে, বাংলার ইতিহাসে সে একজন বীরের ভূমিকায় আছে (বিশেষত বিভিন্ন শ্রেণীর সমাজ বিজ্ঞান বই ঘাটলে তাই জানা যায়)।

মধ্যযুগে বাংলায় সুফিবাদের উদ্ভব ও বিকাশ

প্রকৃতপক্ষে, বাংলায় মুসলিম বিজয়ের সূচনা ঘটেছিল আরও অনেক পূর্বে, পাল শাসনামলে (৭৫০-১১২০) পাল রাজারা ছিলেন বৌদ্ধ, সেই সঙ্গে ছিল তৎকালীন সময়ে হিন্দু সমাজের উঁচু শ্রেণীদের ছিল সাধারণ হিন্দুদের প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য এবং শাস্ত্রের অপব্যাখ্যার প্রবনতা। মূলত সমাজের সামগ্রিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে, উপমহাদেশে ইসলামের প্রচারের মূল লক্ষ্যে সূফীদের আগমন ঘটে বাংলায়।

সূফী-ইজম মিলনের কথা বলে, বলে সম্প্রীতি-শান্তির কথা- এমনটাই শুনে আসছি দীর্ঘসময় থেকে। কিন্তু আদৌতে সূফী কারা বা কীইবা ছিল তাদের ভূমিকা প্রাচীন বাংলায়? এই বিষয়ে বিশদ বিবরণের প্রয়োজন বিদ্যমান। ইতিহাস কখনও সত্য কথা বলে না, ইতিহাস লেখা হয় শাসক ও অভিজাতশ্রেণীর হাত দিয়ে। এই শাসক শ্রেণী তাহাদের বিপক্ষের সকল সত্যকে ইতিহাসের পাতা থেকে ছিঁড়ে ফেলে সেখানে তাহাদের জয়গানের কথাই জুড়ে দেয়। মধ্যযুগ থেকে বাংলা আর সজাতির শাসন পায় নাই, দীর্ঘযুগ অধস্তন হয়েছে বিজাতীয় তুর্কি-আফগান শাসকদের। তাই সঠিক ইতিহাস এখন আর খুঁজে পাওয়া দুস্কর।

সূফীদের আগমন ঘটেছিল প্রধানত ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান, তুর্কীস্তান- এই অঞ্চলগুলো থেকে। বাংলার ইতিহাসে প্রথম সূফী সাধকের কথা পাওয়া যায় পাল শাসনামলে, অর্থাৎ বখতিয়ার খলজির আগমনের অনেক পূর্বেই নীরবে-নিভৃতে তারা ইসলামের দাওয়াতি কর্মকাণ্ড চালু করেছিলেন এবং পরবর্তীতে উপমহাদেশে ইসলামের পতাকায় সুবাতাস প্রদানে তাহাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ফলস্বরূপ, এই পরবর্তী মুসলিম শাসকেরাই সূফীদের চরিত্রকে ইতিহাসে লিখে গেছেন মহামানবের ন্যায়, শান্তির পূজারী-তৎকালীন শাসকদের হাত থেকে সাধারণ প্রজারক্ষার মাসিহা।

কিন্তু প্রকৃত সত্য এই যে, এই সূফীদের সবারই হাত রঞ্জিত হয়েছিল স্থানীয় রাজাদের, সাধারণ মানুষদের রক্তে। আপনি খেয়াল করলেই দেখতে পাবেন, সূফীদের আস্তানা ছিল তৎকালীন রাজ্যগুলোর এক প্রান্তে, বা রাজধানী থেকে অনেক দূরে। সাধারণ মানুষ বলে থাকবেন, বা ইতিহাস আপনাকে জানাবে- এই জ্ঞানীগণ সব সময় জিকির-ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকতেন, তাই জন-কোলাহল থেকে দূরে থাকার এই ব্যবস্থা। কিন্তু আপনি যদি প্রতিটি সূফীর জীবনী ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে গভীর দৃষ্টিপাত করেন তাহলে কিছু সাধারণ কিন্তু গভীর মিল খুঁজে পাবেন। যেমনঃ

১) প্রত্যেক সূফীই ছিলেন অনেক বিদ্বান, বিচক্ষণ এবং জীবনের দীর্ঘ সময় তারা শিক্ষায় অতিবাহিত করেছেন। এমনকি তারা মক্কা এবং অন্যান্য বিখ্যাত ইসলামী শিক্ষালয় থেকে শিক্ষা লাভ করেছিলেন কোরআন হাদিসের ওপরে। আজকের দিনেও অনেক আলেম আছেন যারা এই একই ভাবে শিক্ষা লাভ করেন।

২) তাদের প্রত্যেকের সাথেই তৎকালীন মুসলিম রাজনৈতিক নেতা, সুলতান, প্রভাবশালী ধর্মীয় গুরুদের যোগাযোগ ছিল। বর্তমানেও বিশ্বের বড় বড় আলেমদের সুসম্পর্ক আছে মুসলিম বিশ্বের সাথে।

৩) তারা প্রত্যেকেই যে কোন অঞ্চলে খানকাহ স্থাপনের পূর্বে দীর্ঘদিন ধরে সেই অঞ্চলের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছেন। তাহারা সেই অঞ্চলেই খানকাহ স্থাপন করেছেন যেখানে এই ধরণের কোন সমস্যা পূর্ব থেকেই বিদ্যমান বা রাজশাসন দুর্নীতি বা ত্রুটিযুক্ত।

৪) প্রথমেই তারা তাদের আগমনের বিষয়ে অবিশ্বাস্য এবং ঐশ্বরিয় কাহিনী প্রচার করতেন (উদাহরণ স্বরূপ, কেউ মাছের পিঠে, কেউ কুমিরের পিঠে বা কচ্ছপ-গজার মাছের পিঠে চড়ে যাতায়াত করেন)। নদীমাতৃক বাংলাদেশের এই অঞ্চলে গল্পগুলো খুব দ্রুতই বিস্তার লাভ করতো।

৫) দ্বিতীয়ত, তারা অত্যাচারিত জনবসতিগুলোকে টার্গেট করতো, আজকের ভাষায় যাকে বলা হয় সাইলেন্ট সেল (যারা ভিতর ভিতর ইতোমধ্যে বোমা হয়ে আছে প্রচলিত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক ভূমিকায়, শুধুমাত্র একটি স্ফুলিঙ্গের প্রয়োজন তাদের কে বিস্ফরিত করতে)। এই প্রথা আজও বর্তমান আছে, সুইসাইড স্কোয়াডে প্রথমেই কাজে লাগানো হয় সাইলেন্ট সেল দের।

৬) এই মানুষগুলোর দুঃখ দুর্দশা লাঘবের ছুতোয় তারা তাদেরকে দলে ভেড়াতো। প্রতিবাদ করার ভাষা হিসেবে তাদের যুদ্ধশাস্ত্রে দক্ষ করে তুলতো, আর এবিষয়ে এই সূফীদের সমস্যা হতো না কারণ তাদের সঙ্গে প্রায়ই মুসলিম সুলতানদের সখ্য থাকতো। লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবেন, আজকের বিভিন্ন আঞ্চলিক ইসলামিক জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোও একই কর্ম-পরিকল্পনায় চলছে যা মধ্যযুগে সূফী সাধকেরা করে গেছেন। প্রথমে সমস্যা কবলিত এলাকা সিলেকশন, সাধারণ মানুষদের ব্রেন ওয়াশের মাধ্যমে দলে ভেড়ানো আর প্রশিক্ষন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বা সিরিয়া-জর্ডানের বিভিন্ন রিফুজি ক্যাম্পেও একই ভাবে বিভিন্ন ইসলামিক এন,জি,ও সদস্য সংগ্রহ করে সহায়তার নাম করে।

৭) সূফীগণ যখনই যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করে ফেলতেন, প্রথমেই তারা এমন একটা গুজব ছড়িয়ে দিতেন যাতা তার অনুচররা জীবন দিতেও কুন্ঠা বোধ করবে না, সঙ্গে তাদের সব ধরণের মগজধোলায়। আমি বাংলাদেশের যত মাজার ঘুরেছি, সব খানেই একটা কমন গল্প শুনেছি- অমুক নামে একজন মুসলিম কৃষক ছিল, ছেলের আকিকার জন্য একটা গরু জবাহ করেছিল। তাই শুনে হিন্দু রাজা রেগে তার দুই হাত কেটে দিয়েছে, ছেলেটাকে মেরে ফেলেছে। সেই অমুক মুসলমান তখন পীর/সূফীর কাছে বিচার চেয়েছে। আর সূফী বাবা এই জন্য রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। একজন মুসলমানকে উত্তেজিত করার জন্য এই একটি গল্পই যথেষ্ট। ভাগ্যক্রমে সেদিন ছাফা খানার চল ছিল না, নইলে কোরআন পোড়ানো বা ছেঁড়ার গল্পটাও সূফীগণ সহজেই ব্যহার করে তার অনুগামীদের উত্তেজিত করতে পারতেন, এতো কষ্ট করে গল্প ফেলতে হতো না- কী অমুক রাজা কোরানে আগুন ধরিয়েছে! আর এতো শত বছর পরেও কিন্তু একই ধরণের পরিকল্পনায় ইসলামিকে দেশ গুলোতে সেনাবাহিনীদের ট্রেনিং দেয়া হয়, বা দাঙ্গা-যুদ্ধ তৈরি করা হয়।

৮) যুদ্ধে মুজাহিদিন-জিহাদিদের জয়, স্থানীয় রাজার যুদ্ধে মৃত্যু বা সপরিবারে ইসলামের আদর্শে/ সূফীর মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়ে ইসলাম কবুল। রাজার মৃত্যু হলে রানী/রাজকন্যার প্রাণ ত্যাগ আগুনে/জলে ঝাপ দিয়ে বা সূফী বাবার কোন শিষ্যের যৌনদাসী, ভাগ্য শুভ হলে বিবির মর্যাদা। ইসলামে যুদ্ধ জয়ে অর্জিত সকল সম্পদ হয় বিজিতের এবং একে নাম দেয়া হয় গণিমতের মাল। আই,এস এর ইয়াজিদি মেয়েদের যৌনদাসী হিসেবে বিক্রি, বা ৭১’র যুদ্ধে হিন্দু নারীদের ধর্ষণ, সম্পদ লুটতরাজ একই মুদ্রার বিপরীত পাশ।

৯) যেহেতু সূফীবাবা সংসার ত্যাগী, তাই তিনিতো আর রাজা হতে পারেন না, পাছে লোকে কি বলবে। তাই তার নির্ধারিত কেউ সুলতান হয়ে ইসলামের বিজয়কে চারিদিকে ছড়িয়ে দিতে থাকে। এইবার জনসাধারণের যারা ইসলাম কবুল করবে তাদের সমস্যা নেই, যারা কবুল করতে নারাজ তাদের ওপরেই নেমে আসতো খড়গ। ইতিহাসের পাতায় পাতায় মধ্যযুগীয় বর্বরতার এই সাক্ষর আছে, যা অনেক চেষ্টার পরেও ঢাকা যায় নাই।

১০) সব শেষ কাজ, ইতিহাসের পাতা থেকে সুফী বাবার সব কুকৃতি মুছে ফেলা এবং তাকে মানব থেকে অতি-মানবে পরিণত করার জন্য নতুন ইতিহাস লেখা। আর এই ইতিহাসই আজ আপনি-আমি পরছি। সুফিরা শান্তির দূত, শান্তির বার্তা প্রচার করেছেন। আজ থেকে শত বর্ষ পরে ইসলামিক জঙ্গি গোষ্ঠীর নেতারাও একই ভাবে বন্দিত হবে, সে বিষয়ে আমি একমত। তারাও কথিত হবেন একেকজন সূফী সাধক নামে, যারা সাধারণ মানুষদের অধিকার রক্ষার জন্য লড়াই করে গেছেন।

সূফীদের কর্মপরিকল্পনা এবং বিভিন্ন ইসলামিক জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর কর্মপরিকল্পনা চার্ট আকারে দেখানো হল:

নিচে বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন সুফী সাধকদের নাম, তাদের ভূমিকা তুলে ধরা হলঃ

মাজার একটি আরবি শব্দ, সমার্থক শব্দ দরগাহ। ইসলামে মাজার শব্দটি ব্যবহার করা হয় তীর্থস্থান হিসেবে। ইহা অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, বিভিন্ন সময় হিন্দুগণও বিভিন্ন মাজার ভ্রমণ করেন তীর্থভ্রমনের ন্যায়। তাহারা সেখানে মনস্কামনা পূরনের লক্ষ্যে মানত করেন, সুফী বাবার দরবারে কান্নাকাটি করেন, সিন্নি-ভোগ আর চাদর চড়ান। হিন্দুদের যেকোন পুরাতন বস্তুর ওপরে যে সহজেই ভক্তি জন্মায় তা ইহাতেই প্রমাণিত হয়। কিন্তু ভক্তির পেছিনের গল্পটুকুও তো জানা প্রয়োজন। দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য, একথা আমরা অনেক বারই পরেছি আর এইখানে এই দুর্জন তো আপনার শত্রু। একদিন আপনারই পূর্বপুরুষদের ছলে-বলে-কৌশলে ধংসের পেছনে এই সূফী সাধকেরাই ছিল এবং আপনার উত্তর পুরুষের অস্তিত্ব বিপন্নের পেছনেও তাহারাই থাকবেন। 

সাধারণ মানুষদের পাশাপাশি ভারতের বলিউড সেলিব্রেটি, রাজনৈতিক নেতাদেরও বিভিন্ন সময়ে দেখা যায় আজমির শরীফে খাজা মইনুদ্দিন চিশতী সহ বিভিন্ন স্থানে সূফীদের মাজার পরিদর্শন করে সিন্নি চড়াতে। ১২ আউলিয়ার দেশ চট্টগ্রাম, ৩৬০ আউলিয়ার দেশ সিলেট- আরও কতো হাজার আউলিয়া শুয়ে রয়েছেন এই বাংলার মাটির তলায়। বাংলার প্রতি গ্রামে, প্রতি শহরে এমন নাম না জানা শত শত মাজার-দরগাহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সেই সব আউলিয়াদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল বাংলায় ইসলামের সুপ্রতিষ্ঠা। তারা সফল, আথচ আজও আমাদের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষগুলো নিজেদের রক্তাক্ত ইতিহাস না জেনেই সেই সব মাজারে-দরগায় ভক্তি নিয়ে ভোগ চরান।

সুফিবাদের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ

প্রথম পর্বে আমি দেখানোর চেষ্টা করেছি কিভাবে সুফীদের কর্মকান্ডের সঙ্গে বর্তমান সময়ের জিহাদীদের, তাবলীগ বা ইসলামের দাওয়াতকারীদের গভীর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। যদিও সুফীবাদের সঙ্গে এমনকি প্রথাগত মুসলিম সমাজেরও ব্যপক ফারাক রয়েছে। প্রথাগত সুন্নি মুসলিমগণ প্রায়ই তাহাদের শরিয়ত বিরোধী নাম দিয়ে থাকেন। তবে তাহা আমার আলোচনার মুখ্য বিবেচ্য নহে এবং পরবর্তীতে (প্রয়োজনবোধে) ইহা বিস্তর আলোচনা করা যাবে। আমার মুখ্য আলোচ্য বিষয় হিন্দু সমাজকে কিভাবে এই সুফীগনের প্রাচীনকাল হইতে সুচারুরূপে ফেলা ফাঁদে ফেলেছে ইসলামের প্রচারের উদ্দেশ্যে আর হিন্দু সমাজ তাতে ধরা দিয়ে গত ৯০০-১০০০ বছর বা তারও বেশী সময় ধরে ধর্মীয় ও সামাজিক অবক্ষয়ের পথে চলেছে। একথা জাগতিক সত্য যে অখন্ড ভারতভূমিতে আজ যে ইসলামের অভ্যুত্থান ঘটেছে তাহার সূচনা হয়েছিল এই সুফীদের হাত ধরেই। 

তিন ভাগে সুফীদের আগমনকে ভাগ করা যায়

১) বখতিয়ার খিলজী পূর্ব সময় (১২০৪ এর আগে) আরব বণিকেদের সঙ্গে ইয়ামেন, মক্কা, তুরস্ক ইত্যাদি স্থান থেকে

২) বখতিয়ার খিলজী সম-সাময়িকঃ বিভিন্ন মুসলিম সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায়

৩) মুঘলদের পৃষ্ঠপোষকতায়ঃ ইসলামিক শাসন সুপ্রিতিষ্ঠিত করার জন্য, ঠিক একই কাজ করেছিল স্পেন দক্ষিণ আমেরিকা জয়ের সময়ে খৃষ্টান মিশনারিদের পাঠিয়ে। স্পেনের উপনিবেশ দক্ষিণ আমেরিকার দেশ থেকে উঠে গেছে অনেক আগেই, কিন্তু খৃষ্টান শাসন যায় নাই।

আমার একজন হিন্দু সহপাঠী আছেন, সাধু-সন্তে তাহার এতোটাই ভক্তি যে রাস্তায় বা কোন গাছের নিচে লাল-কালো-গৌরিক জটাজুটধারী কাউকে দেখলেই তাকে মহাসাধু জ্ঞান করে তাহার নিকটে বসে পরে। তাহার ধারণা যে ব্যক্তি সুখের সংসার ত্যাগ করে এমন কৃচ্ছ সাধনের পথ বেছে নিয়েছেন তিনি মহৎ না হয়ে যেতেই পারেন না।

অখন্ড ভারতভূমিতে প্রবেশের শুরুতেই সুফীদের ভারতবাসীর এই দূর্বলতার কথাটি জানা হয়ে গেছে এবং আল্লাহর অলি, সুফি, পীর, ফকির, দরবেশ, গাউস, কুতুব ও সাধক নামে আজ যারা আমাদের মধ্যে পরিচিত, তাহারা সকলেই এই দূর্বলতাকে কাজে লাগিয়েছেন। প্রাচীন আর্যঋষিদের মতো শ্বেতশুভ্র দাঁড়ি, লম্বাচুল, ধবধবে সাদা চামড়া, অতি উচ্চতা, রঙবেরঙের আলখাল্লা, দু’চারটা জাদুকলা, মিষ্টি ব্যবহার, নোঙরখানায় ফ্রি খাবার, আর ছোটখাট যে কোন সমস্যায় মুশকিল আসান এই বাবাদের প্রতি তৎকালীন (এমনকি বর্তমান সময়ের) হিন্দুরা গুরু ভক্তিতে দলেদলে ঝুঁকে পরেন। আমাকে একবার এক হিন্দু ভদ্রলোক গল্প বলছিলেন, “জানেন ঢাকা দেওয়ানবাগী পীরের দরগায় সরস্বতী পূজোর আয়োজন করা হয়”। আমারও জানা মতে এমন ডজনখানেক পীরের নাম নিতে পারব যারা নিজের দরগাহের পাশেই হিন্দু মন্দির স্থাপন করেছেন প্রাচীনকালেই। ইহা যে নিজেদের অসাম্প্রদায়িক ইমেজ তৈরীর উদ্দেশ্যেই, এবং সনাতনীদের আকৃষ্ট করারই একটি উপদায় তা বলার অপেক্ষা থাকে না।

এখানে প্রশ্ন ওঠে, একজন হিন্দু হিসেবে কি সেই সব পীর, অলিদের, বা দরগাহকে সম্মান দেখানো উচিত? অনেকেই মাজার-মানত করে থাকে ভাল কিছুর আশায়। একজন হিন্দু কি তা করতে পারে? ইহা কি হিন্দুর পরিচয় দেয়?

একটা কেস স্টাডি করা যাক। বেশ কয়েক বছর পূর্বে বাংলাদেশের বগুড়া জেলার মহাস্থানগড়ে মাজারে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সেখানে দেখলাম বড় এক হিন্দু পরিবার এসেছে মাজারে সিন্নি দিতে পুরো গাড়ী রিজার্ভ করে। তাদের নাকি বাচ্চা হবার মানত ছিল এই বাবার দরবারে। বিয়ের বেশ কয়েকবছর অতিবাহিত হবার পরেও সেই দম্পতির বাচ্চা হচ্ছিল না। বাবার নামে মানসিত করাতে তাদের বিশ্বাস তারা সন্তানের মুখ দেখতে পাবার সৌভাগ্য লাভ করেছেন। ভগবান যেখানে বিফল, বাবারা সেখানে সচল !

আসুন, এইবারে এই বাবার পরিচয় যেনে নেয়া যাক। ইনি শাহ সুলতান বলখী মাহিসাওয়ার, ১১ শতকের মুসলিম মিশনারী। জনশ্রুতি আছে তিনি এসেছিলেন আফগানিস্তান হইতে মাছের পিঠে চড়ে। প্রথমে তিনি সন্দ্বীপে ইসলাম প্রচার করেন, পরে পুণ্ড্রনগরে আসেন (৪৪০ হিজরী)।

জনাব মাহিসাওয়ার পুন্ড্রবর্ধন এসে হিন্দু রাজা পরশুরামের (নরসিংহ নামেও পরিচিত) কাছে কিছু জমি চাইলেন তার খানকার জন্য। মহৎ উদ্দেশ্যে রাজা জমি দান করলেন। এরপর বাবা প্রথমে চুপি-চুপি অবহেলিত হিন্দুদের ইসলামের দাওয়াতের কাজে নিবেদিত হলেন। পরে রাজার সেনাপ্রধান, মন্ত্রিও ইসলামের দাওয়াত কবুল করে। সমাজ ব্যবস্থা তখন এক যুগসন্ধিক্ষণ পার করছিল ঘোর ব্রাহ্মণ্যবাদীদের ধর্মের অপব্যাখ্যা ও জাতপাতের বিভেদ ইসলাম প্রচারের পথকে প্রশস্ত করেছিল।

কিন্তু তাতেও বাবার মন ভরলনা, শুরু করলেন রাজা পরশুরামকে ক্ষমতাচূত্য করার পরিকল্পনা। কিছু নওমুসলিমদেরকে গোহত্যা করতে উৎসাহিত করতে লাগালেন। ইহা রাজা পরশুরামের সহ্য হলনা। কিন্তু আমাদের দয়াল বাবা ইতোমধ্যে তার পরিকল্পনা গুছিয়ে বসেছিলেন, শিষ্য বেশে দক্ষ আফগান সেনাদের তৈরি রেখেছিলেন যুদ্ধের জন্য। এক রাতের অন্ধকার রাজার দূর্গ (মহাস্তানগড়) আক্রমন করলেন। যুদ্ধে রাজা পরশুরাম নিহত হলেন। আমাদের দয়াল বাবা এইবার রাজা। তার মনে নতুন অভিসন্ধি হইল, তিনি রাজা পরশুরামের ছোট বোন শিলা দেবী কে বিয়ের প্রস্তাব ও ইসলাম কবুলের দাওয়াত দিলেন। শিলা দেবী রাজী না হয়াই জোর করে তার সতীত্ব হরণের চেষ্টা করেন। নিজের সম্ভ্রম রক্ষায় শিলা দেবী করতোয়া নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করলেন (শিলা দেবীর ঘাট নামে মহাস্তানে একটি নদীর ঘাট আছে)। দয়াল বাবা তো রাজা হয়ে মরে গেলেন, রেখে গেলেন মাজার আর বাবার নামে মানত ল্যাগেসি।

পূর্বেই বলেছি, দয়াল বাবা দক্ষিণ বাংলার সন্দ্বীপে প্রথমে আখড়া গড়েছিলেন। পুণ্ড্রবর্ধন ধ্বংসের পূর্বে সেখানের হরিরামনগরের স্থানীয় শাক্ত রাজা বলরামকেও তিনি একই ভাবে যুদ্ধে হারিয়েছিলেন ইসলাম প্রচারে বাধা দেবার অজুহাতে। সেখানেও যুদ্ধে রাজা বলরাম মারা যান এবং তাঁর মন্ত্রী ইসলাম গ্রহণ করে প্রাণ বাঁচান। খেয়াল করলে দেখবেন, আজও তৌহিদ জনতা ইসলামের অপমানের অজুহাতে অমুসলিমদের বাড়িঘরে আগুন দিতে, বা তাদের হত্যা করতে পিছপা হয় না। গতকাল (১৫ জুলাই, ২০২২) বাংলাদেশের নড়াইল জেলার লোহাগড় উপজেলার দিঘলিয়া ইউনিয়নের ৮নম্বর ওয়ার্ডের সাহাপাড়ায় হিন্দুদের উপরে বর্বর আক্রমণ হয়েছে)।

একজন সুফী, যিনি কিনা আল্লাহর পথে, শান্তির পথের পথিক, তিনি কেন একের পরে এক যুদ্ধে জড়াবেন! বিষয়টা কি আপনাদের কাছে আশ্চর্য লাগছে না? তিনি কেন মানুষের রক্তে হাত রাঙাবেন, কেন নারীর শ্লীলতাহানি করার চেষ্টা করবেন? সুফী শব্দের উৎস হিসেবে যে তিনটি অর্থ করা হয়, তার একটি হচ্ছে, “সৎ চরিত্রের অধিকারী”। এহেন ঘটনা কতটা ধার্মিক ব্যক্তির পরিচয় বহন করে বা শান্তির পতাকাবাহী হবার যোগ্যতা প্রদান করে সে বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

শাহ সুলতান বলখীর প্রকৃত পরিচয় এবার উন্মোচনের সময় এসেছে। ইনি ছিলেন আফগানিস্তানের বালখ রাজ্যের সম্রাট শাহ আলী আসগরের পুত্র এবং পিতার মৃত্যুর পর তাকেই সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সেই জন্যই তার নামের শেষে বালখী রয়েছে। কিন্তু তিনি তার সাম্রাজ্য ছেড়ে দরবেশ হয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে তার গুরুর আদেশে ইসলাম প্রচারের জন্য বাংলায় আসেন। কথিত আছে শাহ সুলতান প্রশিক্ষিত যোদ্ধাদের নিরীহ শিষ্যের বেশে এবং নিজে ফকিরবেশে একটি মাছ আকৃতির নৌকাতে করে বাংলায় এসেছিলেন। তা ছাড়া একজন সম্রাট হিসেবে তিনিও আবশ্যই ছিলেন রণনীতিতে সুনিপুন একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। সুতরাং তিনি যে মিশন নিয়ে বাংলায় এসেছিলেন, তা পূর্ব পরিকল্পিত ছিল বললে মিথ্যা বলা হয় না।

যে মানুষ তার আশ্রিত রাজার প্রতি এতবড় বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে, তাকে আর যাই বলা যাক মহামানব বলা চলে নয়া। শান্তির পতাকার আড়ালে লুকানো শাণিত অস্ত্র। ছদ্মবেশে এসে একের পর এক হিন্দু রাজ্য এ’ভাবে ধংস করতে পারে, তার নামে, তার মাজারের নামে মানত কিভাবে একজন হিন্দু করতে পারে? ইসলামে নিজেই এ’ধরণের বিশ্বাসঘাতকদেরকে তো মুনাফেক নাম দিয়েছে। আপনার পূর্বপুরুষদের যে বাস্তুছাড়া করলো, যাদের জন্য আপনি এখন আপন ভূমে পরবাসী, সেই হিন্দু হয়ে আপনি কি সামান্য কিছু পার্থিব লাভের মোহে সেই সুফীর কাছে মাথা নত করবেন? আপনি কি তা করতে পারেন? আমরা অন্য ধর্মের প্রতি এতটাই উদার যে ভগবানরে না, দয়াল বাবার কাছে দুই হাত তুলে চাই ! ধিক, এমন যারা ভাবে, ধিক, যারা করে। তারা কেমন করে এইসব বিশ্বাসঘাতকদের কাছে, হিন্দুদের শত্রুদের কাছে মানত, মাথা নত করতে পারে!

এইখানেই যদি শেষ করতে পারতাম, নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে করতাম। কিন্তু না, আমি দেখেছি অনেক গ্রামে-শহরে বুড়া-বিবি, ওলাবিবি, বনবিবি (বা কোন আঞ্চলিক নাম) নামের একটা জায়গা থাকে যাতে হিন্দু-মুসলিম সবাই শিন্নি দেয়, ধূপ-ধুনো দেয়। সাম্প্রদায়িক ভান কারী বুদ্ধিজীবিদের মুখে বুলি ওঠে, আহা অসাম্প্রদায়িকতার কি দৃষ্টান্ত। আমি বলি নাহ, এই সব বিবির পূজা চলবে না। ইহা মুসলিম ধর্মের প্রচারের হলফনামা। আজ প্রতিটি পীর সাহেবদের দরগাহ, প্রতিটি খানকাহ গড়ে উঠেছে একেকটি হিন্দু রাজ্যের পতনের ধ্বংসাবশেষের ওপরে। এরাই সেই মিশনারী যারা বাংলায় এসেছিল বাংলার হিন্দুদের মুসলমান ধর্মে দীক্ষা দিতে। তাহলে একজন হিন্দু কিভাবে এই কবরের উপর মানত করে, ধুপ-ধুন দেয়? এইটা একটা অপসংস্কার, যা সময়ের পরিক্রমায় হিন্দু সমাজে ঢুকে পরেছে। ইহাকে পরিত্যাগ করতে হবে, নইলে এরকম আরও শতশত অপসংস্কার ও কুসংস্কার মাথা তুলে দাঁড়াবে ভবিষ্যতে।

Leave a Comment