বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের বনসাই বানিয়ে ন্যায্য সমানাধিকার সম্ভব নয়! – ডা.কুশল বরণ চক্রবর্তী

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের বনসাই বানিয়ে ন্যায্য সমানাধিকার সম্ভব নয়

দেশের মানুষের মাঝে একটি অদ্ভুত প্রবণতা দেখা যায়—অন্য দেশের সংখ্যালঘুদের প্রতি গভীর সহানুভূতি আর নিজেদের দেশের সংখ্যালঘুদের প্রতি উদাসীনতা। ফিলিস্তিন, রোহিঙ্গা, ভারত কিংবা চিনের সংখ্যালঘুদের দুঃখে আমাদের চোখে জল আসে। তাদের জন্য আমাদের প্রার্থনা শেষ হয় না। অথচ নিজেদের দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের সমস্যাগুলো দেখেও আমরা যেন অন্ধ।

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের বনসাই বানিয়ে ন্যায্য সমানাধিকার সম্ভব নয়

ডা.কুশল বরণ চক্রবর্তীর সোসাল মিডিয়ার পোষ্ট।
ডা.কুশল বরণ চক্রবর্তীর সোসাল মিডিয়ার পোষ্ট।

বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, যেখানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের সমান অধিকার সংবিধানে সুনিশ্চিত। কিন্তু বাস্তব চিত্র কি তাই? বাস্তবতা হলো, দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় প্রতিনিয়ত নানাভাবে অবহেলার শিকার। তাদের অধিকারের কথা কেউ তেমন গুরুত্ব দিয়ে বলে না। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা গত ৫০ বছরে আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার সময় দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৩.৫ শতাংশ। আজ সেই সংখ্যা নেমে এসেছে মাত্র ৭ শতাংশে। এই বিপুল সংখ্যক মানুষ কেন দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে? কেন তারা নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে?

সংখ্যালঘুদের সমস্যার শিকড় যেখানে

দেশত্যাগের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে ভূমি দখল, ধর্মীয় উগ্রতা, সামাজিক বৈষম্য, এবং রাজনৈতিক চাপ অন্যতম। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ বারবার তাদের সম্পত্তি হারানোর শিকার হয়েছেন। ১৯৬৫ সালের “শত্রু সম্পত্তি আইন” স্বাধীনতার পরে “অর্পিত সম্পত্তি আইন” নামে পরিচিতি পেলেও, এর অপব্যবহার বন্ধ হয়নি। অনেক ক্ষেত্রেই এই আইনের মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি জোরপূর্বক দখল করা হয়েছে।

ধর্মীয় উগ্রবাদও একটি বড় সমস্যা। প্রায়ই শোনা যায় সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় উপাসনালয় আক্রান্ত হচ্ছে। পুজো বা অন্যান্য ধর্মীয় উৎসবগুলোতেও তারা অনেক সময় নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। একদিকে সামাজিক বৈষম্য এবং অন্যদিকে আর্থিক চাপে সংখ্যালঘুদের অনেকেই নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছেন।

সংখ্যা কমিয়ে বনসাই বানানো যেকারনে বিপজ্জনক

সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে অবহেলা বা তাদের সংখ্যা কমিয়ে ফেলা কোনো সমাধান নয়। বরং এটি সমাজের জন্য ভয়ানক সংকেত। একটি রাষ্ট্রে সকল মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করা না গেলে, সেই রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ে। একটি দেশের শক্তি তার বহুত্ববাদে। যদি সংখ্যালঘুদের প্রান্তিক করে রাখা হয়, তাহলে তা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করবে।

বনসাই একটি সাজানো গাছ। এটি বড় হতে দেওয়া হয় না, ছোট রাখতে কেটে-ছেঁটে সুন্দর করে রাখা হয়। কিন্তু মানুষ বনসাই নয়। তাদের চিন্তা, আশা, এবং অধিকারকে কেটে ছেঁটে ছোট রাখা যায় না। সংখ্যালঘুদের ছোট করে রাখলে, তা সমাজে বিভাজন বাড়াবে এবং সবার জন্য একে এক অনিরাপদ পরিবেশ তৈরি করবে।

১. সকলের প্রতি সমান আচরণ: সংখ্যালঘুদের নাগরিক হিসেবে সমান অধিকার দিতে হবে। তারা যেন নিজের দেশেই নিরাপদে বাস করতে পারে, তার জন্য সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে।

২. কঠোর আইন প্রয়োগ: সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি দখল বা হয়রানি বন্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ জরুরি। পাশাপাশি, যেসব ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্তরা ন্যায়বিচার পায়নি, সেগুলো দ্রুত সমাধান করতে হবে।

  1. শিক্ষা এবং কর্মসংস্থান: সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে তারা সমাজে আরো স্বাভাবিকভাবে একীভূত হতে পারবে।
  2. ধর্মীয় সহিষ্ণুতা বৃদ্ধি: ধর্মীয় নেতাদের সক্রিয় ভূমিকা নিয়ে সামাজিক সম্প্রীতি বাড়ানোর কাজ করতে হবে। গণমাধ্যম এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এই বিষয়ে প্রচার চালানো যেতে পারে।
  3. রাষ্ট্রযন্ত্রের দায়িত্ব: রাষ্ট্রকে সংখ্যালঘুদের বিষয়ে আরো দায়িত্বশীল হতে হবে। কেন তারা দেশ ছেড়ে যাচ্ছে, তা খতিয়ে দেখে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

সুশীল সমাজের দায়িত্ব

একটি দেশের প্রকৃত উন্নয়ন তখনই সম্ভব, যখন সমাজের প্রতিটি সদস্য সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে পারবে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষরা এ দেশেরই অংশ। তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ শুধু তাদের ক্ষতি করে না, বরং পুরো জাতির জন্য একটি লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

ফিলিস্তিন বা রোহিঙ্গাদের নিয়ে আমরা যতই চিন্তা করি না কেন, নিজেদের ঘরের মানুষদের যদি দেখভাল না করতে পারি, তবে তা প্রকৃত মানবিকতা নয়। দেশটি সবার। এখানে সবাইকে সমান অধিকার দিতে হবে। সংখ্যালঘুদের বনসাই গাছ বানিয়ে সাজিয়ে রাখলে আমাদের আসল চিত্রটি আরও দুর্বল হয়ে উঠবে।

একটি শক্তিশালী, সহিষ্ণু এবং উন্নত দেশ গড়তে হলে, আমাদের সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা এবং সমানাধিকার নিশ্চিত করতেই হবে। মনে রাখতে হবে, বৈচিত্র্যের মাঝেই ঐক্যের আসল সৌন্দর্য। তথ্যসূত্র: ডা.কুশল বরণ চক্রবর্তী

Leave a Comment