বাংলাদেশে ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশাসনেস (ISKCON)-এর সাথে সংশ্লিষ্ট ১৭ জনের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করেছে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই পদক্ষেপটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক গোয়েন্দা সংস্থা, বাংলাদেশ ফাইনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (BFIU) এর নির্দেশনায় নেওয়া হয়েছে। জানা গেছে, এসব ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ISKCON এবং তার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পর্কিত অর্থনৈতিক লেনদেন ছিল।
এই ১৭ জনের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত নাম চিন্ময় দাস, যিনি আগে ISKCON-এর নেতা ছিলেন। তাঁর গ্রেপ্তারের পর গত কয়েকদিনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সহিংস প্রতিবাদ এবং পুলিশের সাথে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনায় একজন আইনজীবী, সাইফুল ইসলাম, প্রাণ হারিয়েছেন। এ ছাড়া, গ্রেপ্তার হওয়া ১৭ জনের মধ্যে কিছু অন্যান্য নামও রয়েছে যারা ISKCON-এর বিভিন্ন শাখায় কর্মরত ছিলেন। তাদের মধ্যে আছেন: কর্তিক চন্দ্র দে, অনীক পাল, সরোজ রায়, সুশান্ত দাস, বিশ্বকুমার সিংহা, চাঁদিদাস বালা, জয়দেব কর্মকার, লিপি রানি কর্মকার, সুধামা গৌর দাস, লখণ কান্তি দাস, প্রিয়তোষ দাস, রূপন দাস, রূপন কুমার দাস, আশীষ পুরোহিত, জগদীশ চন্দ্র অধিকারী এবং সাজল দাস।
![বাংলাদেশে ISKCON এর ১৭ জনের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ, সংঘাতের নতুন পর্ব।](https://bdhinduinfo.top/wp-content/uploads/2024/11/bangladeesh-potaka-lagano-niye-mamla-1024x576.webp)
ব্যাংক অ্যাকাউন্টের জব্দ এবং আইনগত ব্যবস্থা
বাংলাদেশ ফাইনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (BFIU) এই ১৭ জনের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট স্থগিত করার জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে। এসব অ্যাকাউন্টে সকল ধরনের আর্থিক লেনদেন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এটি করা হয়েছে ২০১২ সালের অ্যান্টি মানি লন্ডারিং আইন এর ২৩(১)(c) ধারা অনুসারে। এই আদেশে বলা হয়েছে, ISKCON এবং তার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা সব ধরনের ট্রান্সাকশন বন্ধ রাখতে হবে। এই স্থগিতাদেশ ৩০ দিন পর্যন্ত কার্যকর থাকবে।
এছাড়া, BFIU দেশের ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে, ৩ কর্মদিবসের মধ্যে তারা এই ১৭ জনের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বিস্তারিত তথ্য সরবরাহ করবে। এ তথ্যের মধ্যে থাকবে ওই ব্যক্তিদের ব্যবসায়িক লেনদেনের আপডেট রেকর্ড। এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার ISKCON এবং তার সাথে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ আরো জোরদার করার চেষ্টা করছে।
অধিকাংশ মানুষের কাছে চিন্ময় দাস পরিচিত ছিলেন চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী নামে। তিনি ISKCON-এর একজন শীর্ষ নেতা ছিলেন এবং বাংলাদেশে তার একটি ব্যাপক অনুসারী ছিল। তবে, তার গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকেই দেশে ব্যাপক প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে। ২৫ নভেম্বর, ২০২৪-এ বাংলাদেশ পুলিশ তাকে মিথ্যে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেপ্তার করে। তার গ্রেপ্তার দেশের বিভিন্ন এলাকায় উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে।
চট্টগ্রামে সহিংস প্রতিবাদ ও আইনজীবীর মৃত্যুর ঘটনা
চিন্ময় দাসের গ্রেপ্তারির পর চট্টগ্রাম শহরে ব্যাপক প্রতিবাদ শুরু হয়। প্রথমে, প্রতিবাদগুলি শান্তিপূর্ণ ছিল, তবে পরবর্তীতে এটি সহিংসতায় পরিণত হয়। পুলিশের সাথে সংঘর্ষের মধ্যে একজন আইনজীবী, সাইফুল ইসলাম, নিহত হন। তিনি একজন আইনজীবী হিসেবে বিভিন্ন মানবাধিকার আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন এবং তার মৃত্যুর পর এটি নিয়ে দেশে উত্তেজনা বেড়ে যায়।
এই ঘটনায় অনেকেই অভিযোগ করেছেন, পুলিশের অপরিপক্ক ব্যবহার এবং সহিংস প্রতিবাদকারীদের উপর অত্যধিক শক্তি প্রয়োগের ফলে আইনজীবী সাইফুল ইসলামের মৃত্যু হয়েছে। সাইফুল ইসলামের মৃত্যু ঘটলে, পুলিশ কয়েকজন হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যদের গ্রেপ্তার করে, যাদের ওপর এ সহিংসতায় জড়িত থাকার মিথ্যে অভিযোগ আনা হয়।
বাংলাদেশের সরকার এবং নির্বাহী প্রতিষ্ঠান ISKCON-এর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে, এ ধরনের পদক্ষেপের সাথে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় কারণগুলোও গুরুত্ব পাচ্ছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় হিন্দু সংগঠন হিসেবে ISKCONের অবস্থা বাংলাদেশে কিছুটা জটিল। একদিকে, এটি ধর্মীয় স্বাধীনতার দাবিতে নিজের অবস্থান শক্ত করতে চায়, অন্যদিকে সরকারের শীর্ষ কর্তৃপক্ষ তাদের কার্যক্রমে কোনো ধরনের অস্বাভাবিকতা বা বিপথগামী কার্যকলাপ মেনে নেবে না।
এ ঘটনা দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মাঝে একটি অস্বস্তি সৃষ্টি করেছে। অনেকেই মনে করছেন, সরকারের এই পদক্ষেপ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রতি এক ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ। অন্যদিকে, সরকারও এই পদক্ষেপের পেছনে নিজেদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার করেছে, অর্থাৎ, তারা একটি অব্যাহত তদন্ত চালিয়ে যাবে এবং জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ বা কোন ধরনের রাষ্ট্রদ্রোহিতাকে বরদাস্ত করবে না।
![বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যা কত 2024](https://bdhinduinfo.top/wp-content/uploads/2024/11/iskcon-bank-account-seized-in-bangladesh-1024x576.jpg)
সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব
বাংলাদেশে ISKCON-এর কিছু নেতাদের গ্রেপ্তার এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দের ঘটনায় সংগঠনের মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। এর ফলে সংগঠনটির কিছু ব্যবসায়িক কার্যক্রম এবং ধর্মীয় কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি হতে পারে। বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, যারা ISKCON বা তার সাথে সম্পর্কিত, তারা এখন বিপদে পড়তে পারে। এই ধরনের পদক্ষেপের প্রভাব সরাসরি তাদের আর্থিক লেনদেন এবং জনগণের মধ্যে সম্পর্কের উপর পড়তে পারে।
তবে, এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের ধর্মীয় অবস্থা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে কিছু প্রশ্নও তুলেছে। বিশেষ করে, যদি কোনো ধর্মীয় সংগঠনকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ ধরনের পদক্ষেপের সম্মুখীন হতে হয়, তাহলে এর সামাজিক প্রভাব কী হতে পারে, তা পরবর্তীতে আলোচনার বিষয় হবে।
বাংলাদেশে ISKCON-এর ১৭ জন সদস্যের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ এবং তাদের বিরুদ্ধে নেওয়া পদক্ষেপগুলো দেশের রাজনীতির একটি নতুন দিক উন্মোচন করেছে। এটি সরকারের কঠোর অবস্থান এবং দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়েও কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। এই ঘটনা ধর্মীয়, সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে আরও এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে পারে, যা আগামী দিনগুলোতে আরো গভীরভাবে আলোচনা হবে।
তবে, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বাংলাদেশ সরকার যাতে সঠিক তদন্ত এবং বিচারের মাধ্যমে এই সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারে এবং দেশের জনগণের মধ্যে শান্তি বজায় রাখতে পারে।