বর্তমান সময়ে হিন্দুত্ব এবং মৌলবাদের মধ্যে তুলনা করা একটি সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এর মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে কতটা যৌক্তিক আলোচনা করা হয়, সেটি ভাবার বিষয়। “হিন্দু মৌলবাদ” বলে যে শব্দবন্ধটি কিছু মানুষের মুখে শোনা যায়, তা মূলত ভুল ব্যাখ্যার ফসল।
হিন্দুত্ব এবং মৌলবাদের পার্থক্য
মৌলবাদ বলতে সাধারণত বোঝানো হয় একটি বিশেষ মতাদর্শের উপর ভিত্তি করে অপরকে চরমভাবে বিরোধিতা করা। কিন্তু হিন্দুত্ব একটি সংস্কৃতি এবং জীবনদর্শন। এটি একটি ধর্মের সীমারেখার মধ্যে আবদ্ধ নয়। হিন্দুত্বে সর্বধর্ম সমন্বয়ের বার্তা স্পষ্ট। অন্যদিকে, যারা হিন্দুত্বকে মৌলবাদের সাথে তুলনা করেন, তারা হয়ত হিন্দুত্বের প্রকৃত গভীরতা বোঝেন না। এটি কেবল একটি ধর্ম নয়, বরং একটি জীবনধারা যা সহিষ্ণুতা, গ্রহণযোগ্যতা এবং মানবতার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।
বিজেপি ও সনাতন সংস্কৃতির সম্পর্ক
ভারতের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিসরে বিজেপি (BJP) একটি বড় ভূমিকা পালন করছে। বিশেষত, তাদের টানা তিনবার ক্ষমতায় আসীন হওয়া হিন্দু সংস্কৃতির প্রভাবকে বুঝতে সাহায্য করে। তবে, এটি বলতে হবে যে বিজেপি একটি রাজনৈতিক দল, যা হিন্দু সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটায় না বরং তার একটি দিককে তুলে ধরে।বিচ্ছিন্ন কিছু অসহনশীল ঘটনার সাথে বিজেপির রাষ্ট্রীয় নীতির কোনও সম্পর্ক নেই। যারা এই ঘটনাগুলিকে তুলে ধরে বিজেপিকে অসহিষ্ণু বলে দাগিয়ে দেন, তারা আসলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এটি সত্য যে কোনো বৃহৎ রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থায় ভুল বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটতেই পারে। তবে সেগুলিকে কেন্দ্র করে সামগ্রিক রাষ্ট্রনীতি বা সংস্কৃতিকে বিচার করা একেবারেই ভুল।
রামরাজত্ব সুশাসনের প্রতীক
রামরাজত্ব শব্দটি ভারতীয় রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। গান্ধীজি রামরাজত্বের কথা বলেছেন, যা আসলে সুশাসনের প্রতীক। এটি কোনও বিশেষ ধর্মীয় শাসন নয়। বরং, এটি এমন একটি শাসনব্যবস্থা যেখানে ন্যায়, সততা এবং মানুষের কল্যাণের উপর জোর দেওয়া হয়। রামরাজত্বের ধারণা সরাসরি মাইথলজিকাল বা পুরাণ নির্ভর নয়। এটি মূলত রামায়ণ এবং অন্যান্য প্রাচীন শাস্ত্রে উল্লেখিত শাসনের ন্যায় ও কল্যাণের মডেল থেকে নেওয়া। রাম ছিলেন এমন একজন শাসক, যিনি তার প্রজাদের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি সবার প্রতি সমান ছিলেন, জাত-পাত বা অন্য কোনও বৈষম্যের ভিত্তিতে কোনও সিদ্ধান্ত নেননি।
রামরাজত্বের সুশাসনের ধারণা গীতার বিভিন্ন শ্লোকে স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। গীতায় কৃষ্ণ বলেছেন যে, একজন শাসকের প্রধান দায়িত্ব হল তার প্রজাদের মঙ্গল নিশ্চিত করা। গীতার মতে, রাজা হলেন জনগণের সেবক। রামের শাসনেও এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে।
রামায়ণে বলা হয়েছে, রামের শাসনে কোনও ক্ষুধার্ত ছিল না, কেউ অসন্তুষ্ট ছিল না, এবং সবাই নিজেদের জীবনে সুখী ছিল। এই আদর্শ সমাজব্যবস্থা গীতার শাসনের নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
![হিন্দুত্ব রামরাজত্ব এবং সুশাসনের বিশ্লেষণ](https://bdhinduinfo.top/wp-content/uploads/2024/12/Leonardo_Phoenix_A_conceptual_artwork_depicting_the_ideals_of_2-1024x579.webp)
রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপট
ভারতে বিজেপি ক্ষমতায় থাকার সময় রামরাজত্বের ধারণাকে একাধিকবার তুলে ধরা হয়েছে। তবে এটিকে শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় প্রচার হিসেবে দেখা ভুল। এটি মূলত একটি আদর্শ সমাজের ধারণা, যা ধর্মীয় গণ্ডির বাইরে দাঁড়িয়ে সমাজের সকলের কল্যাণের উপর জোর দেয়। বিজেপি শাসনামলে কিছু অসহনশীল ঘটনার জন্য সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু এই ঘটনাগুলির সাথে বিজেপির আদর্শগত কোনও সম্পর্ক নেই। যারা এই ঘটনাগুলিকে কেন্দ্র করে বিজেপিকে দোষারোপ করেন, তারা হয়ত বড় পরিসরে দেখতে ব্যর্থ হন।
হিন্দুত্ব এবং রামরাজত্বের ধারণা মৌলবাদ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এগুলি মানবতার কল্যাণ এবং সুশাসনের প্রতীক। যারা হিন্দুত্বকে মৌলবাদের সাথে তুলনা করেন, তাদের এই বিষয়গুলি গভীরভাবে বোঝা উচিত। বিজেপি একটি রাজনৈতিক দল এবং তাদের কর্মকাণ্ডকে হিন্দু সংস্কৃতির পরিপূর্ণ প্রতিফলন মনে করা ঠিক নয়। তবে এটি স্পষ্ট যে, বিজেপি যে সনাতন সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করে কাজ করে, তার মূল লক্ষ্য হল একটি সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা।
রামরাজত্ব হল সেই সুশাসনের প্রতীক, যা কোনও নির্দিষ্ট ধর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি এমন একটি শাসনব্যবস্থা, যেখানে ন্যায়বিচার, কল্যাণ এবং মানবতার মঙ্গল নিশ্চিত হয়। এই ধারণার উপর ভিত্তি করেই গান্ধীজি ভারতবর্ষের সুশাসনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। আমাদের উচিত এই আদর্শগুলিকে শ্রদ্ধা করা এবং একটি উদার ও সহিষ্ণু সমাজ গঠনে এগিয়ে যাওয়া। এটি কেবল আমাদের সংস্কৃতির সমৃদ্ধি ঘটাবে না, বরং একটি সত্যিকারের রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করবে।