জগন্নাথ হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ঐতিহাসিক ও প্রাচীন হল। এটি মূলত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের (হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান) ছাত্রদের জন্য সংরক্ষিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় যে তিনটি হল নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল, জগন্নাথ হল তার মধ্যে অন্যতম। মানিকগঞ্জের জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরীর পিতা জগন্নাথ রায় চৌধুরীর নামে এই হলের নামকরণ করা হয়। এই হলের প্রথম প্রভোস্ট ছিলেন অধ্যাপক নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত। পরবর্তীতে অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি এই হলের প্রভোস্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, যেমন অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু, অধ্যাপক জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব প্রমুখ।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এই হলে হামলা চালিয়ে অনেক শিক্ষক ও ছাত্রকে হত্যা করে। এর মধ্যে ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য সহ অনেকেই শহীদ হন। জগন্নাথ হলের অভ্যন্তরে নির্মিত বধ্যভূমিটি সেই নৃশংসতার সাক্ষী হয়ে আছে।
১৯৯৬ সালে জগন্নাথ হলে পুলিশের বর্বর হামলা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য হলের তুলনায় জগন্নাথ হল বারবার সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার হয়েছে। ১৯৭১ সালের পর ১৯৯৬ সালের ৩১ জানুয়ারি এই হলে পুলিশের বর্বর হামলা চালানো হয়। এই হামলার পেছনে ছিল তৎকালীন সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। ১৯৯৬ সালের জানুয়ারি মাসে সরকার বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে উঠেছিল। বিরোধী দলীয় ছাত্রসংগঠনগুলো প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বাংলা একাডেমির বইমেলা উদ্বোধন প্রতিরোধ করতে চেয়েছিল। এই প্রতিবাদ দমনের জন্য পুলিশ জগন্নাথ হলে হামলা চালায়।
৩১ জানুয়ারি, প্রায় ৭০০ পুলিশ ও বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) সদস্য জগন্নাথ হলে প্রবেশ করে। তারা ছাত্রদের উপর অমানবিক নির্যাতন চালায়। ছাত্রদের মারধর করে, তাদের কক্ষ লুট করে, বইপত্র নষ্ট করে এবং ধর্মীয় প্রতীকগুলিকে অপবিত্র করে। পুলিশ ছাত্রদের উপর চরম সাম্প্রদায়িক কটূক্তি করে এবং তাদেরকে “মালাউন” (অপমানজনক শব্দ) বলে ডাকে। এই হামলা প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে চলে। হলের প্রায় ৪০টি কক্ষ তছনছ করা হয়। প্রায় ২০০ ছাত্র আহত হয় এবং ৯৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের মধ্যে ৫৪ জনকে আদালতে চালান করা হয়, যদিও তাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
হামলার প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা
এই হামলার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র শ্রীকঙ্কন কান্তি ঘোষ। তিনি তার বর্ণনায় বলেন, পুলিশ হলের প্রতিটি কক্ষে ঢুকে ছাত্রদের মারধর করে। তারা ছাত্রদেরকে অশ্রাব্য ভাষায় গালি দেয় এবং ধর্মীয় প্রতীকগুলিকে অপমান করে। পুলিশের আক্রমণে অনেক ছাত্র আহত হয় এবং কিছু ছাত্র জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করে। শ্রীকঙ্কন কান্তি ঘোষ বলেন, “পুলিশের আক্রমণের সময় আমি ভয়ে কাঁপছিলাম। তারা আমাদেরকে গরু-ছাগলের মতো জড়ো করে প্রিজন ভ্যানে তুলে দেয়।”
এই হামলার পর দেশব্যাপী তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন, বুদ্ধিজীবী এবং মানবাধিকার সংগঠন এই হামলার নিন্দা জানায়। জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট এবং হাউস টিউটররা পদত্যাগ করেন। তারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে আহত ছাত্রদের চিকিৎসা এবং গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের মুক্তির দাবি জানান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমদ এই ঘটনায় কোনো সক্রিয় ভূমিকা রাখেননি। তিনি আহত ছাত্রদের দেখতে হাসপাতালে যাননি এবং ছাত্রদের সাথে দেখা করেননি। তার এই নিষ্ক্রিয়তা অনেকের কাছেই নিন্দার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
এই হামলার পেছনে তৎকালীন সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কাজ করেছিল। ১৯৯৬ সালের জানুয়ারি মাসে সরকার বিরোধী আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠেছিল। বিরোধী দলীয় ছাত্রসংগঠনগুলো প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বাংলা একাডেমির বইমেলা উদ্বোধন প্রতিরোধ করতে চেয়েছিল। এই প্রতিবাদ দমনের জন্য পুলিশ জগন্নাথ হলে হামলা চালায়। এই হামলার মাধ্যমে সরকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করে।
হামলার শিকার ছাত্রদের তালিকা
ক্রমিক নং | ছাত্রের নাম | রুম নম্বর |
---|---|---|
১ | নারায়ণ চন্দ্র ঘোষ | ৩৮০ |
২ | রমেশ চন্দ্র বিশ্বাস | ৩৮৩ |
৩ | পঙ্কজ কর্মকার | ৩৩০ |
৪ | বিপ্লব কুমার সরকার | ৩৮০ |
৫ | প্রকাশ অধিকারী | ৩৬২ |
৬ | সুভাষ চন্দ্র | ৩৬১ |
৭ | শুভ প্রসাদ | ৩৮২ |
৮ | অশোক কুমার মুখার্জী | ৩০৮ |
৯ | রাজেশ চাঘা | ৩১৪ |
১০ | রঞ্জন সরকার | ৩৮৩ |
১৯৯৬ সালের ৩১ জানুয়ারি জগন্নাথ হলে পুলিশের হামলা ছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর একটি নির্মম ও নিষ্ঠুর আক্রমণ। এই হামলার মাধ্যমে তৎকালীন সরকার তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে চেয়েছিল। এই ঘটনা আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় যে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতনের ইতিহাস এখনও শেষ হয়নি। এই হামলার শিকার ছাত্রদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা আমাদের সকলের দায়িত্ব।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি:
১. শাহরিয়ার কবির (সম্পাদিত), ‘৩১ জানুয়ারি ১৯৯৬ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে পুলিশী হামলার শ্বেতপত্র’, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, ঢাকা: প্রথম প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬
২. কঙ্কর সিংহ, ‘রাষ্ট্র সাম্প্রদায়িকতা এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়’, অনন্যা, ঢাকা: প্রথম প্রকাশ, জানুয়ারি ১৯৯৯
ড. শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়