শৈব শব্দটি বাংলায় অনেক প্রেক্ষাপটে ব্যবহৃত হয়। এটি মূলত হিন্দু ধর্মের একটি বিশেষ তত্ত্ব বা ধারণার সাথে সম্পর্কিত। শৈব শব্দের মানে, সাধারণভাবে, শিব এর সাথে সম্পর্কিত, যাকে হিন্দু ধর্মে আধ্যাত্মিকতা, শক্তি, সৃজন এবং ধ্বংসের দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হয়। শৈব শব্দটি মূলত শিব পূজারী বা শিব ধর্মাবলম্বী ব্যক্তিদের বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। তবে এর আরো অনেক গভীর অর্থও রয়েছে, যা ধর্ম, সংস্কৃতি, ইতিহাস, এবং দর্শনীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে আলাদা আলাদা মর্ম প্রকাশ করে। শৈব শব্দটি বাংলা ভাষায় হিন্দু ধর্মের বিশেষ এক তত্ত্ব থেকে এসেছে, যা শিব এর অনুসারী বা শিবের ধর্মীয় আদর্শকে বোঝায়। হিন্দু ধর্মে শিবকে এক সুপরিচিত দেবতা হিসেবে পূজা করা হয়। শিবকে আদ্যাশক্তি এবং মহাশক্তির প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। এই কারণেই শৈব শব্দটি শিবের সাথে সম্পর্কিত এবং শিবের ভক্ত বা পূজারীকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।
শৈব ধর্মের মূল তত্ত্ব
শৈব ধর্ম, যা “শৈবিজম” নামে পরিচিত, হিন্দু ধর্মের একটি প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায়। এটি মূলত শিবের পূজা ও শ্রদ্ধা করার উপর নির্ভরশীল। শৈব ধর্মের মূল তত্ত্ব হলো, পৃথিবী এবং সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড শিবের দ্বারা সৃষ্ট এবং শিবের মাধ্যমেই তার ধ্বংসও ঘটবে। শৈব ধর্মে বিশ্বাসীরা শিবকে “সর্বোচ্চ সত্তা” বা “পরম সত্য” হিসেবে পূজা করেন। তাঁদের মতে, শিবের মধ্যেই সমস্ত সৃষ্টির রহস্য এবং এর শেষ রয়েছে।
শৈব শব্দটি বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে প্রধানত দুটি দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করা যায়। প্রথমত, শৈব শব্দটি সরাসরি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যবহৃত হয়, যেখানে এটি শিবের ভক্ত বা শিব ধর্মাবলম্বীকে বোঝায়। দ্বিতীয়ত, শৈব শব্দটি সংস্কৃতির বিভিন্ন দিকেও ব্যবহার হতে পারে, যেমন শৈব সংগীত, শৈব সাহিত্য বা শৈব ঐতিহ্য।
শৈব ধর্মের প্রধান উপাস্য
শৈব ধর্মের মূল উপাস্য হলেন শিব। শিবকে বিভিন্ন নাম ও রূপে পূজা করা হয়, যেমন মহাদেব, নীলকণ্ঠ, ভোলেনাথ, নটরাজ, ইত্যাদি। শিবের নানা রূপ ও গুণাবলি সম্পর্কে শৈব ধর্মে নানা দর্শন ও মতামত রয়েছে। শৈব ধর্মের অনুসারীরা বিশ্বাস করেন যে, শিব ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত সৃষ্টি ও ধ্বংসের আদি ও অন্ত। শিবের শক্তি অনন্ত এবং সর্বব্যাপী। শৈব সংস্কৃতির মধ্যে রয়েছে আধ্যাত্মিক সাধনা, গান, নৃত্য এবং পূজার নানা ধারা। শৈব সম্প্রদায়ের মানুষরা বিশেষ করে “লিঙ্গ পুজা” বা শিবলিঙ্গ পূজায় অনেক গুরুত্ব দেয়। শিবলিঙ্গ শিবের মূল প্রতীক হিসেবে পূজা করা হয় এবং এটি শৈব সম্প্রদায়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ।
শৈব ধর্ম এবং বৈষ্ণব ধর্মের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। বৈষ্ণব ধর্মের অনুসারীরা ভগবান বিষ্ণুকে পূজা করে, যেখানে শৈব ধর্মের অনুসারীরা শিবকে সর্বোচ্চ দেবতা হিসেবে পূজা করেন। শৈব এবং বৈষ্ণব ধর্মের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক দিক থেকে কিছু পার্থক্য থাকতে পারে, তবে দুটি ধর্মের মূল লক্ষ্য একটাই – মানুষের আত্মমুক্তি এবং ঈশ্বরের সাথে মিলন।
শৈব শব্দের আধুনিক ব্যবহার
বর্তমানে শৈব শব্দটি শুধু ধর্মীয় দিকেই সীমাবদ্ধ থাকে না। এটি আধুনিক সমাজের বিভিন্ন দিকেও ব্যবহৃত হয়। শৈব ধর্মের অনুগামী বা শিবের পূজারি হিসেবে পরিচিত অনেক মানুষ আজকাল শৈব শব্দটি গর্বের সাথে ব্যবহার করেন। এছাড়াও, শৈব শব্দটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন বা ধর্মীয় বিশ্বাসের আওতায় বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।
শৈব ধর্মের আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে শিবকে সবকিছু তৈরির সত্তা এবং ধ্বংসের সত্তা হিসেবে দেখানো হয়। শৈব দর্শনে শিবের পূজা করার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি নিজের আত্মাকে খুঁজে পায় এবং জীবনের চরম লক্ষ্য, আত্মমুক্তি বা “মোক্ষ” অর্জন করতে পারে। শৈব ধর্মের অনুসারীরা মনে করেন যে, শিবের পূজা ও সাধনার মাধ্যমে তারা আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভ করতে পারেন এবং জীবনের সমস্ত দুঃখ-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে পারেন। শৈব শব্দটি একদিকে হিন্দু ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ একটি ধারণা, অন্যদিকে এটি আধ্যাত্মিকতা, সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের অঙ্গীকারও। শৈব শব্দের মাধ্যমে শিবের পূজা, ধর্মীয় ভাবনা এবং তার দর্শন সম্বন্ধে অনেক কিছু শেখা যায়। এটি শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই নয়, বরং আধুনিক সমাজে এর বহুমুখী ব্যবহারও এটি এক বিশেষ স্থান অধিকারী করে রেখেছে। শৈব ধর্মের বিশ্বাসীরা নিজেদের অন্তর্দৃষ্টি ও আধ্যাত্মিক সাধনা দ্বারা জীবনের সর্বোচ্চ সত্যকে অর্জন করতে চান।