বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা সংস্থা “ইউনাইটেড স্টেটস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম” (USCIRF) এর সাবেক প্রধান জনি মুর (Johnnie Moore) সম্প্রতি বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর ক্রমবর্ধমান নিপীড়নের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে তীব্র সমালোচনা করেছেন এবং বলছেন, “বাংলাদেশে এমন কোন সংখ্যালঘু গোষ্ঠী নেই যারা বর্তমানে হুমকির মুখে নয়।” তার মতে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে পরিস্থিতি বর্তমানে এমন একটি জায়গায় পৌঁছেছে, যেখানে তারা নিজেদের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
মুরের বক্তব্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় হলো, বাংলাদেশে হিন্দুদের এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ এবং হুমকি বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি বাংলাদেশ সরকারের উপর আক্রমণের দায় চাপিয়ে বলেন, দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা সুরক্ষা করা সরকারের প্রাথমিক দায়িত্ব। মুর বলেন, “এটা শুধু বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের জন্য এক অভ্যন্তরীণ সংকট নয়, বরং পুরো দেশের জন্য একটি অস্তিত্ব সংকট।”
এই আলোচনা শুরু হয়েছে বাংলাদেশের এক বিশিষ্ট হিন্দু পুরোহিত চিন্ময় কৃষ্ণ দাস এর গ্রেফতার নিয়ে। সম্প্রতি তাকে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়, যা বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে বড় ধরনের উদ্বেগ তৈরি করেছে। মুরের মতে, “যদি তারা তাকে গ্রেফতার করতে পারে, তবে তারা যে কোনো একজনকেই গ্রেফতার করতে পারে।” এই ঘটনায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে ভয় এবং উদ্বেগ আরও বৃদ্ধি পায়।
জনি মুর তার বক্তব্যে বাংলাদেশে ইন্টারিম প্রধান মুহাম্মদ ইউনুসে সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, “মুহাম্মদ ইউনুস ব্যর্থ হচ্ছেন।” ইউনুসের নেতৃত্বে দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং আইনের শাসন যে কীভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে, সে বিষয়ে মুর বেশ উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, “যদি সরকার জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারে, তবে সেটি বড় বিপদ।” তার মতে, বাংলাদেশে আইনের শাসন এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে, এখন কেউ নিরাপদ নয়। মুর আরও বলেন, “যখন আইনজীবীকে হত্যার মতো ঘটনা ঘটে, তখন এ থেকে স্পষ্ট যে, আইনজীবীরাও নিরাপদ নন।”
মুরের বক্তব্যে প্রাধান্য পাচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট, বাংলাদেশে আইনের শাসন ধ্বংসপ্রাপ্ত এবং সাধারণ মানুষের অধিকার নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে। তিনি সেসব ঘটনাও তুলে ধরেন, যেখানে একজন হিন্দু পুরোহিত গ্রেফতার হওয়ার পর তার পক্ষে আইনি সাহায্য চাওয়ার সময় তার আইনজীবীকে হত্যার ঘটনা ঘটে। এর ফলে দেশের মধ্যে তীব্র প্রতিবাদ এবং হইচই সৃষ্টি হয়।
মুর বলেন, বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল, যিনি সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি মুছে ফেলার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, তার এই বক্তব্যও বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে, বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা মুছে ফেলা হলে তা দেশটির সংখ্যালঘু জনগণের জন্য আরও বিপজ্জনক হতে পারে। মুর মনে করেন, বাংলাদেশ যদি ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোর কাছ থেকে পরামর্শ নেয়, তাহলে তারা নিজের দেশের ধর্মীয় প্রতিযোগিতা এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষা করতে সক্ষম হবে। তিনি বলছেন, “এই ধরনের সংকট সমাধানে বাংলাদেশকে ভারতের মতো অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হতে পারে, যেখানে ধর্মীয় বহুত্ববাদকে কার্যকরভাবে পরিচালনা করা হয়েছে।”
মুরের মন্তব্যের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হচ্ছে, বাংলাদেশ একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হলেও, এখানে বহু সংখ্যালঘু ধর্মীয় গোষ্ঠী বসবাস করে। তার মতে, বিশ্বের খ্রিস্টান সম্প্রদায় বাংলাদেশে হিন্দুদের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ এবং তাদের অধিকার রক্ষায় আন্তর্জাতিকভাবে সমর্থন প্রকাশ করেছে। তিনি বলেন, “বিশ্বের খ্রিস্টান সম্প্রদায় বাংলাদেশের হিন্দুদের পাশে দাঁড়িয়েছে।” এই বক্তব্যের মাধ্যমে মুর বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় আন্তর্জাতিক সমর্থনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরছেন।
মুরের উদ্বেগের মধ্যে আরও একটি বিষয় হলো, বাংলাদেশের সরকার যদি এই সংকট মোকাবিলা না করতে পারে, তবে দেশের জন্য তা দীর্ঘমেয়াদী পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। তিনি উল্লেখ করেন, যে সমস্ত সরকার এসব সমস্যার গুরুত্ব না বুঝে ক্ষুদ্রতর রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তাদের ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ক্ষতি হতে পারে। বিশেষ করে, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত উন্নতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি বাংলাদেশ এই সংকট মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়, তবে ভারতের সাথে এর সম্পর্কের ওপরও বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।
সংক্ষেপে, জনি মুরের মন্তব্যগুলি বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও ধর্মীয় পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে। বিশেষ করে, সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ এবং তাদের নিরাপত্তাহীনতা দেশের জন্য বড় ধরনের সংকট তৈরি করেছে। বাংলাদেশের সরকার যদি দ্রুত এই সংকটের মোকাবিলা না করে, তবে এর পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। বিশেষ করে, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা, আইনের শাসন, এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উপর এই সংকটের প্রভাব বাংলাদেশের ভবিষ্যত উন্নয়নকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে।
এখন দেখার বিষয় হবে, বাংলাদেশের সরকার এই সংকট মোকাবিলায় কিভাবে পদক্ষেপ নেয় এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কিভাবে তাদের প্রতি সমর্থন প্রদান করে।